মাগুরা জনতা ব্যাংকের প্রধান শাখায় এক দশক আগে মারা যাওয়া আতিকুর রহমান নামে এক মৃত গ্রাহকের হিসাব থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ৮ লাখ টাকা উত্তোলনের ঘটনা জানাজানির হওয়ায় পুনরায় গ্রাহকের ওয়ারিশদের টাকা ফেরত দিলো ব্যাংক কর্মকর্তারা। এতে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে সাধারণ গ্রাহকদের মাঝে।
মৃত গ্রাহকের ভাতিজা গোলাম হায়দার জানান, মাগুরা শহরের আতর আলী সড়কের আতিকুর রহমান ২০০২ সালের ৩০ মে মাগুরা জনতা ব্যাংকের প্রধান শাখায় একটি সঞ্চয়ী হিসাব (নং- ০১০০০১১৩১৮২৩৬) খোলেন। তিনি ২০১৩ সালে মারা যান। মারা যাওয়ার সময় তাঁর ওই ব্যাংক হিসেবে ৮ লাখ ৪৮ হাজার ৯২৬ টাকা সঞ্চয় ছিল। ওই হিসাবে কোন নমিনির নাম উল্লেখ ছিলো না। নমিনি না থাকলে নিয়মানুযায়ী ওই টাকা তুলতে উত্তোরাধিকার সনদের প্রয়োজন হয়। আদালতে উত্তোরাধিকার সনদ পেতে ‘ব্যাংকস্টেটমেন্ট’ দাখিল করতে হয়। ব্যাংকের শাখায় ‘ব্যাংকস্টেটমেন্ট’ তোলার সময় মূলত জালিয়াতির ঘটনা ফাঁস হয়।
তিনি বলেন, গত ৩০ আগস্ট (বুধবার) ব্যাংকস্টেটমেন্ট তুলতে গেলে ব্যাংকের ম্যানেজার জানান ওই হিসাবে মাত্র ৩৪ হাজার ৯৯১ টাকা আছে। কিন্তু আমরা তাঁকে জানাই ওই হিসাবে মোট ৮ লাখ ৪৮ হাজার ৯২৬ টাকা ছিল। ওই টাকা কোথায় গেল তা জানতে চাইলে ম্যানেজার আমাদের জানান ৩৪ হাজার ৯৯১ টাকা ছাড়া আপনাদের হিসাবে কোনো টাকা নেই। টাকা থাকলে সেই টাকা কোথায় যাবে। পরে আমরা ম্যানেজার মিলন কুমার দত্তের কাছে ব্যাংক হিসাবে জমা থাকা টাকার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখাই। তখন তিনি বিব্রতবোধ করে বলেন, আমি নতুন এসেছি। খোঁজখবর নিয়ে দেখি। আপনারা দুই তিনদিন পর আসেন। গত ৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে ব্যাংকের ম্যানেজারের দেওয়া ‘ব্যাংকস্টেটমেন্ট’ দেখা যায়, ওই ব্যাংক হিসাবে ৮ লাখ ৩৪ হাজার ৯৯১ টাকা জমা রয়েছে। অথচ দুদিন আগে বলা হয়েছিল ৩৪ হাজার ৯৯১ টাকা ছাড়া কোনো টাকা নেই। ওই ৮ লাখ টাকা দুদিনের মধ্যে কোথা থেকে একাউন্টে আসল জানতে চাইলে ম্যানেজার কোনো সদুত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যান।এসময় তিনি বলেন, আপনাদের টাকা তো আপনারা পেয়েছেন। এ নিয়ে আর মাথা ঘামানোর দরকার নেই।
ব্যাংকস্টেটমেন্ট ও অন্যান্য কাগজপত্র পর্যালোচনা করে জানা গেছে, মূলত আতিকুর রহমানের ওই ব্যাংক হিসাব থেকে ২০২০ সালের ১৯ অক্টোবর রামিসা এন্টারপ্রাইজ (হিসাব নম্বর- ০১০০২১৩২৬০৮৬৮) নামের চলতি হিসাবে প্রথমে ৫ লাখ টাকা সরানো হয়। যার রেফারেন্স নম্বর-এফটি২০২৯৩এম৩কেএম৬;১। নিয়মানুযায়ী টাকা সরানোর ভাউচারটি প্রস্তুত করেন ব্যাংকের তৎকালিন কর্মকর্তা মো. মাজেদুল ইসলাম এবং অনুমোদন দেন ব্যাংকের আরেক কর্মকর্তা রোজিনা পারভীন।
এঘটনার ছয়দিন পর (২৫ অক্টোবর) আতিকুর রহমানের হিসাব থেকে আবারও রামিসা এন্টারপ্রাইজের হিসাবে ৩ লাখ টাকা সরানো হয়। যার রেফারেন্স নম্বর-এফটি২০২৯৯সিএইচসি৭বি;১। এ ভাউচারটি প্রস্তুত করেন ব্যাংকের তৎকালিন কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার বিশ্বাস এবং অনুমোদন দেন ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা রোজিনা পারভীন।
ঘটনা সম্পর্কে জানতে রামিসা এন্টারপ্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারী শামীমআরার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে কথা হয় তাঁর স্বামী ফরিদ খানের সাথে। তিনি বলেন, রামিসা এন্টারপ্রাইজ নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি আমার স্ত্রীর নামে। প্রতিষ্ঠানের নামে মাগুরা জনতা ব্যাংকের প্রধান শাখায় একটি চলতি হিসাব (নম্বর-০১০০২১৩২৬০৮৬৮) রয়েছে। টাকা জালিয়াতি করে আমাদের একাউন্টে সরানো সম্পর্কে আমরা আগে কিছুই জানতাম না। তবে ব্যাংকের বর্তমান ম্যানেজার কিছুদিন আগে আমাদের ব্যাংকে ডেকে নিয়ে যান। তখন তিনি একটি জমা ভাউচারে সই করিয়ে নেন। তখন ওই জালিয়াতির বিষয়টি জানতে পারি। যা করেছে ব্যাংকের লোকজন। দায় দায়িত্ব সবই তাদের। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যাংকের দুজন কর্মকর্তা জানান, প্রিন্সিপাল অফিসার মো. রফিকুল ইসলাম (রিপন) ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি প্রধান শাখায় শাখা ব্যবস্থাপক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি যোগদানের পর থেকেই নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন। গ্রাহকের ঋণ পেতে তাঁকে নির্দিষ্ট অংকের টাকা ঘুষ দিতে হতো। ব্যাংকের উধ্বর্তন প্রভাবশালী এক সাবেক কর্মকর্তা তাঁর নিকটাত্মীয় পরিচয়ে তিনি সবাইকে জিম্মি করে রেখেছিলেন। তাঁর ভয়ে ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারি কথা বলতে সাহস পেত না। বিষয়টি উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষও জানেন। তবে এতদিন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সবশেষ তাঁকে শাখা থেকে সরিয়ে এরিয়া অফিসে সংযুক্ত করা হয়। তিনি ৪ বছর এখানে কর্মরত ছিলেন। চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি মাসে তাঁকে এরিয়া অফিসে বদলী করা হয়।
মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে মাগুরা জনতা ব্যাংকের প্রধান শাখার তৎকালিন ব্যবস্থাপক মো. রফিকুল ইসলাম (রিপন) বলেন, ওই টাকা ভুল ট্রান্সফার হয়েছিল। এটা হতেই পারে। সমাধান হয়ে গেছে। গ্রাহকের ওয়ারিশগণ তাদের টাকা ফেরত পেয়েছেন। এ নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই।প্রথম ভাউচার প্রস্তুতকারী ব্যাংক কর্মকর্তা মো. মাজেদুল ইসলাম (বর্তমানে শ্রীপুর উপজেলার লাঙ্গলবাঁধ শাখার ব্যবস্থাপক) বলেন, ওই সময় আমি আমানত বিভাগে কাজ করতাম। আমার আইডি ব্যবহার করে ওই টাকা সরানো হলেও আমি এই ব্যাপারে কিছুই জানি না। ঘটনা জানার পরদিন (৪ সেপ্টেম্বর) আমি বিষয়টি তদন্তের জন্য উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষকে লিখিত ভাবে জানিয়েছি।
জানতে চাইলে ব্যাংকে ওই সময় কর্মরত আরেক কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার কুন্ডু ওই ধরণের কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করেন। তবে টাকা সরানোর দুই ভাউচারের অনুমোদনকারি কর্মকর্তা রোজিনা পারভীন ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, বিষয়টি উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষ দেখছেন।
জানতে চাইলে বর্তমানে প্রধান শাখার ব্যবস্থাপক মিলন কুমার দত্ত বলেন, উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানাতে পারব না। আপনারা উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করুন।
এ ব্যাপারে গত শনিবার রাতে (১৬ সেপ্টেম্বর) জনতা ব্যাংকের ফরিদপুর অঞ্চলের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) মো. মাহবুব হাসানের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমে ঘটনার সত্যতা অস্বীকার করেন। তবে কথপোকথনের এক পর্যায়ে তিনি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, বিষয়টি উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব এখন কর্তৃপক্ষের।
এদিকে মৃত ব্যক্তির হিসাব থেকে টাকা অন্য হিসাবে মাধ্যমে উত্তোলনের ঘটনায় ক্ষুব্ধ ভুক্তভোগীরা এ বিয়ষের সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। পরবর্তীতে যেন কোন গ্রাহক এমন ঘটনায় শিকার না হয় এমনটিই তাদের চাওয়া।
Leave a Reply